ঈদে মিলাদুন্নবী ২০২৫: ইতিহাস, গুরুত্ব, ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পালন পদ্ধতি

ঈদে মিলাদুন্নবী-২০২৫

ঈদে মিলাদুন্নবী ২০২৫: ইতিহাস, গুরুত্ব, ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি ও পালন পদ্ধতি

ভূমিকা

ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, আর এই জীবনব্যবস্থার শ্রেষ্ঠ আদর্শ হলেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)। তাঁর আগমন বিশ্ববাসীর জন্য ছিল এক মহান রহমত।

আল্লাহ বলেন:
“আমি তোমাকে সমগ্র জগতবাসীর জন্য রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।”
সূরা আল আনবিয়া: ১০৭

ঈদে মিলাদুন্নবী হলো সেই দিনটি, যেদিন বিশ্বনবীর আগমন ঘটেছিল। মুসলিম বিশ্বের একাংশ এই দিনটিকে স্মরণ করে বিভিন্নভাবে—দোয়া, দরূদ, সীরাত পাঠ, মাহফিল ইত্যাদির মাধ্যমে।

যদিও এই দিবস উদযাপন নিয়ে ইসলামি স্কলারদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে, তবে একমত হওয়া যায় এই ব্যাপারে নবীজির জীবন ও আদর্শ জানা, মানা এবং অনুসরণ করাই হলো মুসলমানের প্রকৃত দায়িত্ব।

এই আর্টিকেলে আমরা আলোচনা করব:
ঈদে মিলাদুন্নবীর প্রকৃতি, ইতিহাস, ইসলামিক ব্যাখ্যা
জায়েজ, নাজায়েজ মতামত
নবীজির জীবনী ও শিক্ষা
এবং এ দিবস পালনের শরিয়তসঙ্গত দৃষ্টিভঙ্গি

আসুন জেনে নিই, ঈদে মিলাদুন্নবী আসলে কী এবং ইসলামের আলোকে এর সঠিক অবস্থান কী।

ঈদে মিলাদুন্নবী কি?

ঈদে মিলাদুন্নবী বলতে বোঝানো হয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)এর জন্মদিন পালনকে। এটি ইসলামি ক্যালেন্ডারের রবিউল আওয়াল মাসের ১২ তারিখে পালিত হয়। ‘মিলাদুন্নবী’ শব্দটির অর্থ “নবীর জন্ম” বা “নবীর জন্মদিন”। এই দিনটি মুসলিম সমাজে নবীজির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে উদযাপিত হয়।

ঈদে মিলাদুন্নবী পালন মূলত নবীজির জীবন, কর্ম ও শিক্ষাকে স্মরণ এবং অনুসরণের আহ্বান জানায়। এই দিনে মুসলমানরা বিশেষ দোয়া, কোরআনের তিলাওয়াত, ধর্মীয় আলোচনা ও সামাজিক মিলনমেলার মাধ্যমে নবীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে থাকে।

তবে ঈদে মিলাদুন্নবীর ওপর ইসলামি মতামত বিভক্ত। কিছু মুসলিম গোষ্ঠী এটিকে নববীয় সুন্নাহর বাইরে মনে করে এবং এই উৎসবকে মানেন না, কারণ সরাসরি কোরআন বা সহিহ হাদীস থেকে এর কোনো নির্দেশনা নেই। অন্যদিকে, অনেক মুসলিম সম্প্রদায় এটিকে নবীজির প্রতি ভালোবাসা ও সম্মানের একটি সুন্দর মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে।

অর্থাৎ, ঈদে মিলাদুন্নবী হলো নবীজির জন্মদিন উদযাপন, যা মুসলিম সমাজের মধ্যে তাঁর শিক্ষা ও আদর্শকে স্মরণ ও প্রণোদনার জন্য পালন করা হয়।

ঈদে মিলাদুন্নবী অর্থ কি?

ঈদে মিলাদুন্নবী শব্দটি আরবি থেকে এসেছে। এখানে “ঈদ” শব্দের অর্থ হলো উৎসব বা আনন্দের দিন, আর “মিলাদুন্নবী” অর্থ নবীর জন্ম। একত্রে অর্থ দাঁড়ায় “নবীর জন্মের উৎসব” বা “নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)এর জন্মদিন পালন”।

ইসলামি ইতিহাস ও সমাজে ঈদ বলতে সাধারণত দুই ধরনের উৎসব বোঝানো হয় ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। কিন্তু “ঈদে মিলাদুন্নবী” শব্দটি নবীর জন্মদিন উদযাপনের জন্য ব্যবহৃত হয়, যা মূলত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে একটি বিশেষ দিন।

এই দিনটি মুসলিম সম্প্রদায়ের কাছে প্রিয় নবীর জীবনী, আদর্শ ও শিক্ষা স্মরণ করার একটি পবিত্র উপলক্ষ হিসেবে গণ্য। অর্থাৎ, ঈদে মিলাদুন্নবীর অর্থ শুধু জন্মদিন উদযাপন নয়, এটি নবীজির প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও আনুগত্যের প্রকাশ।

ঈদে মিলাদুন্নবী সম্পর্কে ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি

ঈদে মিলাদুন্নবী বা নবীজির জন্মদিন পালনকে কেন্দ্র করে ইসলামের বিভিন্ন মতামত বিদ্যমান। মূলত এই উৎসবের বৈধতা ও জায়েজতা নিয়ে আলেমদের মধ্যে মতভেদ লক্ষ্য করা যায়।

নববীয় সুন্নাহর অভাব

ঈদে মিলাদুন্নবী পালন সম্পর্কে সবচেয়ে বড় ইসলামিক বিতর্ক হলো, নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কিংবা তাঁর সাহাবাগণ এই উৎসব পালন করেননি। কোরআন ও সহিহ হাদীসে নবীর জন্মদিন উদযাপনের কোনো নির্দেশনা পাওয়া যায় না। অতএব, কিছু ইসলামি শিক্ষাবিদ এটি নববীয় সুন্নাহর বাইরে গণ্য করেন এবং নববীয় আদর্শ থেকে বিচ্যুতি হিসেবে দেখেন।

নবীর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনের গুরুত্ব

অন্যদিকে, অনেক মুসলিম সম্প্রদায় নবীর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করে থাকে। তারা মনে করেন, নবীর জন্মদিন উদযাপন তার জীবনী ও শিক্ষা স্মরণ করার জন্য একটি উপকারী পন্থা। এতে নবীর আদর্শ থেকে শিক্ষা গ্রহণ ও মুসলিম সমাজে ঐক্য বৃদ্ধি পায়।

ইসলামী মতামত ও দলিলসমূহ

  • সহীহ বুখারি ও মুসলিম এ নবীর জীবনী ও সুন্নাহ সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা থাকলেও জন্মদিন পালনের কোনো উল্লেখ নেই।
  • কিছু আলেম বলেন, নববীয় সুন্নাহর বাইরে যাওয়া যাবে না (বাইদাউদ, নাসায়ি)।
  • অন্যদিকে, ঐতিহাসিকভাবে, মুসলিম সমাজে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক সম্প্রদায়ে ঈদে মিলাদুন্নবী পালন বহুল প্রচলিত।

সারাংশ
ঈদে মিলাদুন্নবী সম্পর্কিত ইসলামিক মতামত দ্বৈত এক পক্ষ এটিকে নববীয় সুন্নাহর বাইরে ও নিষিদ্ধ মনে করে, অন্য পক্ষ নবীর প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ হিসেবেই গ্রহণ করে। তাই এই বিষয়টি নিয়ে আলেমদের মতামত ভিন্ন হওয়ায় ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও সম্প্রদায়ভেদে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়।

ঈদে মিলাদুন্নবীর ইতিহাস

ঈদে মিলাদুন্নবী বা নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্মদিন উদযাপনের ইতিহাস শতবর্ষ পুরনো নয়। সরাসরি নবীজির সময় কিংবা তাঁর সাহাবাদের যুগে এই দিনটি উদযাপিত হতো না। এটি মূলত পরবর্তীতে মুসলিম সমাজে প্রবর্তিত একটি ঐতিহ্য।

ঈদে মিলাদুন্নবী কখন থেকে শরু হয়েছে?

  • ঈদে মিলাদুন্নবীর উৎসব প্রথমদিকে ইসলামী মূলধারার বাইরে বেশি জনপ্রিয় হয়েছিলো। ইতিহাসে দেখা যায়, বিশেষ করে ১২শ শতাব্দীর পর থেকে দক্ষিণ এশিয়া, মিশর ও তুর্কি অঞ্চলে মওলিদ পালন প্রচলিত হতে শুরু করে।
  • মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে এটি বৃহত্তর পরিসরে পালিত হতো এবং ইসলাম সমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

মাওলিদ শব্দের অর্থ জন্ম বা উৎপত্তি এবং এর প্রথম ব্যবহারও ছিল নবীজির জন্মদিন স্মরণে। তবে এটি ইসলামের প্রধান উৎসব ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার পাশাপাশি বিশেষ এক ঐতিহ্যগত অনুষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেছে।

বিতর্ক ও সমালোচনা

ঈদে মিলাদুন্নবীর ইতিহাস জুড়ে বিতর্ক ও সমালোচনা থেকেছে। অনেক ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় পণ্ডিত বলেন, নবী ও তাঁর সাহাবাদের যুগে এই উৎসব ছিল না, তাই এটি পরবর্তীতে যোগ করা হয়েছে।

তবে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে এই উৎসব মুসলিম সমাজে নবীর প্রতি ভালবাসা ও শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

ঈদে মিলাদুন্নবীর গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ঈদে মিলাদুন্নবী শুধু একটি ঐতিহাসিক দিন বা উৎসব নয়, বরং এটি মুসলিমদের জন্য নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনের শিক্ষার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রকাশ। এই দিনটি মুসলিম সমাজে একতাবদ্ধতা, ধর্মীয় চেতনা এবং মানবিক মূল্যবোধের উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

নবীর জীবনের আদর্শ স্মরণ

নবীজির জীবন হলো মুসলিমদের জন্য এক আদর্শ। তাঁর ধৈর্য, সহনশীলতা, দয়া ও ন্যায়পরায়ণতার শিক্ষা ঈদে মিলাদুন্নবীর মাধ্যমে স্মরণ করা হয়। এই দিনটি নবীর শিক্ষা ও আদর্শ অনুসরণের জন্য প্রেরণা জোগায়।

ঐক্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের উন্নয়ন

ঈদে মিলাদুন্নবী মুসলিম সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে। এই দিনে সকল স্তরের মানুষ একত্রিত হয়ে নবীর জীবনী ও শিক্ষার আলোকে সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য কাজ করার প্রেরণা পায়।

ধর্মীয় চেতনার জাগরণ

নবীজির প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার এই উৎসব মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় চেতনা বাড়ায়, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনে ইসলামিক নীতি ও আদর্শ পালনে সাহায্য করে।

মানবিক মূল্যবোধের প্রচার

ঈদে মিলাদুন্নবীর মাধ্যমে মানবতা, দানশীলতা, সহানুভূতি এবং পরোপকারের মূল্যবোধ প্রচারিত হয়, যা নবীর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

ঈদে মিলাদুন্নবী কেন পালন করা হয়?

ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করার প্রধান উদ্দেশ্য হলো নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনী, শিক্ষা এবং আদর্শকে স্মরণ করা এবং মুসলিম সমাজে নবীর প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করা।

নবীর জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ

মুহাম্মদ (সা.) এর জীবন ও চরিত্র মুসলিমদের জন্য নিদর্শন। তাঁর সহিষ্ণুতা, দয়া, ন্যায়পরায়ণতা এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ঈদে মিলাদুন্নবীর মাধ্যমে পুনরায় স্মরণ করা হয়, যা সমাজে সঠিক নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে।

ইসলামী ঐক্য ও সংহতি বৃদ্ধি

ঈদে মিলাদুন্নবী মুসলমানদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রতীক হিসেবে কাজ করে। এই দিনে মুসলিম সমাজ একসাথে মিলিত হয়, ধর্মীয় আলোচনা, দোয়া ও অন্যান্য অনুষ্ঠান দ্বারা সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়।

নবীর প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ

নবীজির জন্মদিন উদযাপনের মাধ্যমে মুসলিমরা তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ করে। এটি নবীর প্রতি আনুগত্য ও সম্মানের প্রতীক।

ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করা কি?

ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করা ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ কি না এটি একটি বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত বিষয়। কোরআন ও সহিহ হাদীসে সরাসরি এই উৎসব পালনের কোনো নিদর্শন নেই, ফলে আলেমদের মধ্যে মতভেদ দেখা যায়।

ঈদে মিলাদুন্নবী কারা বৈধ মনে করেন:

  • নেক ইসলামিক পণ্ডিত ও মাজহাবভিত্তিক আলেম (বিশেষ করে সুফি ধারার অনুসারীরা) বলেন, ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের মাধ্যমে নবীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ হয়।
  • তাঁরা বলেন, যদি কোনো কাজ কোরআন ও সুন্নাহর বিরোধিতা না করে, এবং তা ইবাদতের নিয়তে না হয়ে স্মরণ ও শিক্ষা প্রচারের উদ্দেশ্যে হয়, তবে তা বৈধ হতে পারে।

দলিল হিসেবে ব্যবহার করা হয়:

কোরআন:
“তোমরা বল, ‘আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া দ্বারা, সুতরাং এতে তারা আনন্দ করুক’
সূরা ইউনুস, আয়াত ৫৮
(অনেকে বলেন, আল্লাহর অনুগ্রহ মানে হল নবীর আগমন)

হাদীস:
রাসূল (সা.) প্রতি সোমবার রোযা রাখতেন। কারণ, তিনি বলেন, “এই দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি।”
সহিহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২
(এখানে কেউ কেউ বলেন, নবীর জন্মদিন স্মরণযোগ্য হতে পারে)

ঈদে মিলাদুন্নবী কারা বিদআত মনে করেন:

  • সালাফি ও অনেক হানাফি/শাফিঈ আলেম বলেন, নবী (সা.) নিজে বা সাহাবারা কখনও এই দিন উদযাপন করেননি।
  • ইসলামে ইবাদতের মধ্যে নতুন কিছু সংযোজন করা বিদআত। তাই ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের ধারাটি শরীয়তসম্মত নয় বলে মনে করেন তারা।

হাদীস:
“যে আমার ধর্মে এমন কিছু সংযোজন করল, যা এতে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত।”
সহিহ বুখারি, হাদীস ২৬৯৭

সারসংক্ষেপ
ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করা নিয়ে ইসলামী স্কলারদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। কারো কাছে এটি নবীর প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ, কারো কাছে এটি বিদআত। তাই মুসলমানদের উচিত দলিলভিত্তিক জ্ঞান অর্জন করে সচেতনভাবে অবস্থান গ্রহণ করা।

ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করা কি জায়েজ?

ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করা জায়েজ (বৈধ) কি না এ প্রশ্নে ইসলামী স্কলারদের মধ্যে দুইটি প্রধান মত বিদ্যমান। কেউ বলেন, এটি জায়েজ ও উপকারী একটি কাজ, আবার কেউ বলেন, এটি বিদআত ও শরীয়ত পরিপন্থী।

ঈদে মিলাদুন্নবী কারা জায়েজ বলেন, তাঁদের যুক্তি কি?

  • নবীর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ ঈদে মিলাদুন্নবী পালন নবীজির জীবনী স্মরণ ও তার প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের একটি মাধ্যম।
  • শরীয়ত বিরোধী কিছু না থাকলে বৈধ কোরআন সুন্নাহ বিরোধী কিছু না থাকলে নতুন ইবাদত না করে শিক্ষামূলকভাবে পালন করা বৈধ হতে পারে।

দলিল:
“তোমরা বল, এটি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়ায়, সুতরাং এতে তারা আনন্দ করুক।”
সূরা ইউনুস, আয়াত ৫৮

“আমি সোমবার রোযা রাখি, কারণ এই দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি।”
সহিহ মুসলিম, হাদীস: ১১৬২

এদের মতে, নবীর জন্ম আনন্দ ও প্রশংসার যোগ্য, তাই এটি স্মরণযোগ্য।

ঈদে মিলাদুন্নবী কারা নাজায়েজ মনে করেন, তাঁদের যুক্তি কি?

  • নবী ও সাহাবারা পালন করেননি রাসূল (সা.) খলিফাগণ, সাহাবারা এমন কোনো উৎসব করেননি।
  • ইসলামে ইবাদতের ক্ষেত্রে নতুন সংযোজন বিদআত।

দলিল:
“যে আমাদের এই দীনে এমন কিছু সংযোজন করল যা এতে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত।”
সহিহ বুখারি, হাদীস: ২৬৯৭

“প্রত্যেক নতুন উদ্ভাবন (বিদআত) গোমরাহী।”
আবু দাউদ, হাদীস: ৪৬০৭

সারসংক্ষেপ:
ঈদে মিলাদুন্নবী পালন জায়েজ কি না, তা নির্ভর করে উদ্দেশ্য, পদ্ধতি ও কেন পালন করা হচ্ছে তার উপর।
কেউ শিক্ষা ও ভালোবাসার ভিত্তিতে পালন করে তাদের মতে এটি জায়েজ।
কেউ শরীয়তের বাইরে উৎসব হিসেবে পালন করে তাঁদের মতে এটি বিদআত।

ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন পদ্ধতি

ঈদে মিলাদুন্নবী মুসলিম সমাজে নানা উপায়ে উদযাপন করা হয়, যা দেশের সংস্কৃতি, সম্প্রদায় ও ইসলামিক চিন্তাধারার ভিন্নতার উপর নির্ভর করে। তবে মূল লক্ষ্য থাকে নবী মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনী স্মরণ, তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ এবং তাঁর শিক্ষা অনুসরণ।

  1. কোরআন তিলাওয়াত ও দোয়া মাহফিল
    এই দিনে মসজিদ ও ঘরে কোরআন তিলাওয়াত, দোয়া মাহফিল ও যিকির আযকারের আয়োজন করা হয়। অনেক স্থানে নবীজির জন্য দুরুদ পাঠ ও বিশেষ মোনাজাত করা হয়।
  2. ইসলামী আলোচনা ও মিলাদ মাহফিল
    নবীজির জীবন, চরিত্র, আখলাক ও তাঁর আদর্শ নিয়ে আলোচনাসভা বা ওয়াজ মাহফিল হয়। এতে মানুষ নবীর জীবনী সম্পর্কে জানতে ও শিক্ষা নিতে পারে।
  3. দান, খয়রাত ও সমাজসেবা
    এই দিনে অনেক মুসলিম দরিদ্রদের মাঝে খাবার বিতরণ, কাপড় বা অর্থ প্রদান, হাসপাতাল ও এতিমখানায় সাহায্য প্রদান করে থাকেন।
  4. ঘরবাড়ি ও রাস্তা সাজানো
    অনেক দেশে (বিশেষ করে উপমহাদেশে) রাস্তাঘাট, মসজিদ ও ঘরবাড়ি আলোকসজ্জা করা হয়। কিছু জায়গায় মিছিল বা র‍্যালিরও আয়োজন করা হয়।
  5. ইসলামিক প্রতিযোগিতা ও শিক্ষা কার্যক্রম
    বাচ্চাদের জন্য ইসলামিক কুইজ, হামদনাত প্রতিযোগিতা, কবিতা আবৃত্তি ইত্যাদি আয়োজনের মাধ্যমে ঈদে মিলাদুন্নবীকে শিক্ষামূলক রূপ দেওয়া হয়।

ঈদে মিলাদুন্নবী বিধি বিধান

ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন বিষয়ে ইসলামী শরীয়তের নির্দিষ্ট কোনো বিধান কোরআন ও সহিহ হাদীসে নেই। ফলে এর বিধি বিধান নির্ধারণে আলেমদের ব্যাখ্যা ও মতামতই মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।

ইসলামিক দৃষ্টিতে মূলনীতি

ইসলামে কোনো ইবাদত, অনুষ্ঠান বা আমলকে বৈধ হতে হলে তা কোরআন ও সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত হতে হবে। যদি কোনো কাজ নবী (সা.) বা সাহাবিদের যুগে না থাকে, তবে তাকে বিদআত হিসেবে গণ্য করা হয়।

হাদীস:
"যে ব্যক্তি এমন কোনো আমল চালু করল, যা আমার শরীয়তে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত।"
সহিহ বুখারি, হাদীস: ২৬৯৭

ঈদে মিলাদুন্নবী যদি পালন করা হয়, তাহলে কি কি শর্ত মানা জরুরি:

  • ইবাদতের নিয়তে না করা ঈদে মিলাদুন্নবীকে 'ফরজ' বা 'সুন্নত' ইবাদত মনে করা যাবে না।
  • কোনো হারাম কাজ যেন না হয়: গান বাজনা, নারীদের অশালীন অংশগ্রহণ, অপচয় ইত্যাদি পরিহার করতে হবে।
  • নবীজির জীবনী আলোচনা, দুরুদ, কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে সীমিত থাকা

ফিকহী অবস্থান:

  • হানাফি, শাফিই ও মালিকি মাজহাবের কিছু আলেম শর্তসাপেক্ষে এই দিবস স্মরণকে বৈধ মনে করেন।
  • হাম্বলি ও সালাফি চিন্তাধারার আলেমরা এটিকে বিদআত বলে বিবেচনা করেন।

সারসংক্ষেপ
ঈদে মিলাদুন্নবী পালনের জন্য শরীয়ত নির্ধারিত কোনো নির্দিষ্ট বিধান নেই। তবে কেউ যদি শিক্ষা ও স্মরণমূলকভাবে পালন করেন এবং শরীয়তের সীমা অতিক্রম না করেন, তাহলে অনেক আলেম তা “নতুন সংস্কার না করে” মাকরুহ বা জায়েজ বলে থাকেন।

ঈদে মিলাদুন্নবীর দলিল

ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করার পক্ষে সরাসরি কোনো কোরআনিক আয়াত বা সহিহ হাদীসে স্পষ্ট দলিল নেই। তবে যারা এটিকে বৈধ বা জায়েজ মনে করেন, তারা কিছু আয়াত ও হাদীস থেকে পরোক্ষ দলিল পেশ করে থাকেন।

১. কোরআন থেকে দলিল:

“তুমি বলো, ‘এটি আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণার কারণে; অতএব এতে তারা আনন্দ করুক। এটি যা তারা জমা করে তার চেয়ে উত্তম।”
সূরা ইউনুস, আয়াত ৫৮
অনেকে বলেন, আল্লাহর এই অনুগ্রহ ও রহমত বলতে নবী মুহাম্মদ (সা.)এর প্রেরণাই বোঝানো হয়েছে। তাই তাঁর আগমনে খুশি প্রকাশ করা বৈধ।

২. হাদীস থেকে দলিল:

রাসূল (সা.) বলেন:
“আমি সোমবার রোযা রাখি, কারণ এই দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি।”
সহিহ মুসলিম, হাদীস: ১১৬২

এই হাদীস থেকে বোঝা যায়, নবীজী নিজেই তাঁর জন্মদিন স্মরণ করতেন—রোযা রাখার মাধ্যমে। তাই জন্মদিন স্মরণ করা জায়েজ হতে পারে, তবে শরিয়তের সীমায়।

৩. সাহাবা ও তাবেয়ীদের যুগে দুরুদ ও নবীর জীবনী আলোচনা:

যদিও সাহাবারা মিলাদুন্নবী উদযাপন করেননি, তবে তারা রাসূল (সা.) এর জীবনী পড়া, আলোচনা করা এবং তাঁর প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করতেন, যা আজকের মিলাদের ভিত্তি হিসেবে অনেকে মানেন।

৪. ইতিহাস থেকে দলিল:

ইমাম জালালুদ্দিন সুওয়ুতী, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি প্রমুখ আলেম মিলাদ পালনের পক্ষপাতী ছিলেন। তাদের মতে, যদি মিলাদ শরীয়তবিরোধী কিছু ছাড়াই হয়, তবে তা মুবাহ বা ন্যূনতম জায়েজ হতে পারে।

সারসংক্ষেপ:
ঈদে মিলাদুন্নবীর সরাসরি দলিল না থাকলেও কিছু আয়াত ও হাদীসের ব্যাখ্যার মাধ্যমে এবং অতীত ফকীহদের মত অনুযায়ী একে স্মরণমূলক উৎসব হিসেবে বৈধ বলে বিবেচনা করা হয় যদি তা বিদআত ও হারাম কার্যক্রম মুক্ত হয়।

ঈদে মিলাদুন্নবীর নাজায়েজ হওয়ার দলিল

ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন অনেক আলেমের দৃষ্টিতে নাজায়েজ বা শরীয়তবিরোধী। তাদের মতে, এটি একটি বিদআত” (ইসলামে নব সংযোজন), যা রাসূল (সা.), সাহাবা বা তাবেয়ীগণের যুগে ছিল না। এরা বিভিন্ন সহিহ হাদীস ও ইসলামী নীতিমালার আলোকে দলিল পেশ করেন।

১. বিদআত সংক্রান্ত হাদীস

রাসূল (সা.) বলেন:
"যে কেউ আমাদের দ্বীনে এমন কিছু চালু করল, যা এতে নেই, তা প্রত্যাখ্যাত।"
সহিহ বুখারি: ২৬৯৭, সহিহ মুসলিম: ১৭১৮

"প্রত্যেক নতুন বিষয়ই বিদআত, আর প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহী।"
আবু দাউদ: ৪৬০৭, তিরমিজি: ২৬৭৬
এই হাদীসগুলো দ্বারা বোঝানো হয়, নবী (সা.)এর দ্বীনের মধ্যে নতুন কোনো ইবাদত বা উৎসব চালু করা যাবে না।

২. সাহাবাদের যুগে মিলাদ পালনের নজির নেই

নবী (সা.) এর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সাহাবারা তাঁর প্রতি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসা পোষণ করতেন। কিন্তু তাঁদের কেউ কখনও ১২ রবিউল আউয়াল উদযাপন করেননি। সুতরাং, কেউ যদি নবীকে ভালোবাসার দাবিতে মিলাদ উদযাপন করে, তবে তা প্রকৃত সুন্নাহর বিরোধী।

৩. ইসলামি ক্যালেন্ডারে অনুমোদিত মাত্র দুটি ঈদ

রাসূল (সা.) বলেন:
"আল্লাহ তোমাদের জন্য এর চেয়ে উত্তম দুটি ঈদ (ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা) দিয়েছেন।"
আবু দাউদ: ১১৩৪
এর বাইরে অন্য কোনো ঈদ বা উৎসব শরিয়ত সম্মত নয়।

৪. অপসংস্কৃতি ও বাড়াবাড়ি

অনেক ক্ষেত্রে ঈদে মিলাদে গানবাজনা, মিছিল, মাজারে শিরকি কার্যক্রম, আলোকসজ্জা, অপচয় ইত্যাদি দেখা যায়, যা শরিয়ত অনুযায়ী হারাম। এইসব কার্যকলাপ মিলাদ উদযাপনকে সম্পূর্ণ নাজায়েজ করে তোলে।

সারসংক্ষেপ:
ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন কোরআন ও হাদীস, সাহাবা ও ইসলামের মূল শিক্ষায় প্রমাণিত না হওয়ায় বহু আলেম এটিকে বিদআত ও নাজায়েজ হিসেবে ফতোয়া দেন। তারা বলেন, ইবাদতে নতুন সংযোজন দ্বীনের বিকৃতি ডেকে আনে।

মিলাদুন্নবী এর গুরুত্ব ও শিক্ষা

মিলাদুন্নবী বা ঈদে মিলাদুন্নবী কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়; এটি মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণের উপলক্ষ। তাঁর জন্ম, জীবন ও নবুয়তের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই দিন স্মরণ করা হয়।

১. নবীজির আগমনের গুরুত্ব

নবী মুহাম্মদ (সা.) এর আগমন মানবজাতির জন্য ছিল এক বিশাল অনুগ্রহ।

আল্লাহ বলেন:
"আমি তোমাকে সমগ্র জগতের জন্য রহমতরূপে প্রেরণ করেছি।"
সূরা আল আনবিয়া: আয়াত ১০৭

এই আয়াতের আলোকে বুঝা যায়, তাঁর জন্ম ও আগমন
মানবতার মুক্তির চাবিকাঠি।

২. শিক্ষা: চরিত্র ও আখলাক

নবীজির চরিত্র ছিল সর্বোত্তম।

আল্লাহ বলেন:
"তুমি নিশ্চয়ই মহান চরিত্রের অধিকারী।"
সূরা আল কলম: আয়াত ৪

মিলাদুন্নবী আমাদের শেখায়:

  • সত্যবাদিতা
  • ধৈর্য
  • নম্রতা
  • দয়া ও ক্ষমাশীলতা
  • আল্লাহভীতি ও তাকওয়া

৩. দাওয়াহ ও মানবতার শিক্ষা

নবীজী পুরো জীবনই মানুষকে আল্লাহর পথে ডেকেছেন। তিনি যে দাওয়াহ করেছেন, তা কেবল মুসলিমদের জন্য নয়, বরং সমস্ত মানবজাতির কল্যাণে।

৪. মিলাদের শিক্ষা:

  • নবীর জীবনী জানার আগ্রহ তৈরি হয়
  • সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন গড়ার প্রেরণা জাগে
  • সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ, শান্তি ও সহানুভূতি প্রসার পায়

সারসংক্ষেপ:
মিলাদুন্নবী উদযাপন যদি কেবল উৎসব না হয়ে হয় নবীর আদর্শ চর্চা ও শিক্ষার উপলক্ষ, তাহলে এর গুরুত্ব অনেক গভীর। এ দিনটি মুসলমানদের মনে নবীর প্রতি ভালোবাসা ও ইসলামী জীবনের চেতনা জাগ্রত করে।

ঈদে মিলাদুন্নবী নিয়ে ইসলামিক মতামত

ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করা নিয়ে ইসলামি স্কলারদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ এটিকে শরিয়তসঙ্গত মনে করেন, কেউ বলেন এটি বিদআত এবং জায়েজ নয়। নিচে দুই পক্ষের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরা হলো:

১. মিলাদুন্নবী সমর্থনকারী আলেমদের মতামত

মূল পয়েন্ট:
নবী (সা.) এর জন্মদিন স্মরণ করা, তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা, দুরুদ পাঠ করা, কোরআন তিলাওয়াত ও দোয়া মাহফিল করা এসব শরিয়ত বিরোধী নয়, বরং তা প্রেরণাদায়ক ও কল্যাণকর।

উল্লেখযোগ্য আলেম:
ইমাম জালালুদ্দিন সুয়ুতী (রহ.)
ইমাম ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.)
ইমাম সাখাভী (রহ.)

দলিল:
সূরা ইউনুস: ৫৮ (আল্লাহর অনুগ্রহে আনন্দ প্রকাশ)
সহিহ মুসলিম: ১১৬২ (নবী সোমবার রোযা রাখতেন তাঁর জন্ম স্মরণে)

তাঁদের মতে, বিদআত সেই আমল যা শরিয়ত বিরোধী। কিন্তু মিলাদ যদি সীমার মধ্যে থাকে, তা হলে তা 'বিদআতে হাসানাহ' (ভাল বিদআত) হিসেবে গণ্য হতে পারে।

২. বিরোধী আলেমদের মতামত

মূল পয়েন্ট:
নবী (সা.), সাহাবা, তাবেয়ীন কেউ এ দিবস উদযাপন করেননি। ইসলাম নির্দিষ্ট উৎসব দিয়েছে—ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা। এর বাইরে কোনো উৎসব শরিয়তসম্মত নয়।

উল্লেখযোগ্য আলেম:
ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহ.)
ইমাম শাতিবী (রহ.)
আধুনিক সালাফি চিন্তাবিদগণ

দলিল:
সহিহ বুখারি: ২৬৯৭ (বিদআত প্রত্যাখ্যাত)
আবু দাউদ: ৪৬০৭ (প্রত্যেক বিদআত গোমরাহী)

সারসংক্ষেপ:
ঈদে মিলাদুন্নবী নিয়ে ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি দুটি:
যারা সীমার মধ্যে থেকে পালন করেন, তাঁরা এটিকে নবীর স্মরণ ও শিক্ষা ছড়ানোর সুযোগ মনে করেন।
যারা শরিয়ত অনুসরণে কড়াকড়ি করেন, তাঁরা এটিকে বিদআত ও অনুচিত মনে করেন।

ঈদে মিলাদুন্নবী এবং প্রিয় নবীর জীবনী

ঈদে মিলাদুন্নবী মানেই শুধু নবীজির জন্মদিন উদযাপন নয়, বরং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ নবী মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনী জানার, বুঝার এবং জীবনে বাস্তবায়নের জন্য।

নবীজির জন্ম ও বংশ পরিচয়

  • জন্ম: ১২ রবিউল আউয়াল, ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দ (আবরাহার হস্তী অভিযান বছরের সাথে মিলিত)
  • স্থান: মক্কা শরীফ
  • পিতা: আব্দুল্লাহ (ইন্তেকাল করেন জন্মের পূর্বে)
  • মাতা: আমিনা
  • বংশ: কুরাইশ, হাশিম বংশ

আল্লাহ বলেন:
"নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে একজন রাসূল এসেছেন তোমাদের মধ্য থেকেই"
সূরা আত তাওবাহ: ১২৮

নবুয়তের শুরু

  • ৪০ বছর বয়সে হেরা গুহায় ওহি নাজিল হয়।
  • প্রথম ওহি: সূরা আলাক: ১-৫
  • নবুয়তের শুরুতে ১৩ বছর মক্কায়, পরে ১০ বছর মদিনায় দাওয়াত দিয়েছেন।

নবীজির চরিত্র ও আদর্শ

আল্লাহ বলেন:
"তুমি তো মহৎ চরিত্রের অধিকারী।"
সূরা আল কলম: ৪

  • সততা (আল আমিন নামে পরিচিত)
  • দয়া ও ক্ষমাশীলতা
  • সহিষ্ণুতা
  • সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা
  • নারীর সম্মান, দাস মুক্তি ও দারিদ্র্য বিমোচনে অসামান্য অবদান

নবীর জীবনের শিক্ষা

ঈদে মিলাদুন্নবী আমাদের মনে করিয়ে দেয়:
নবীর আদর্শ অনুসরণই আমাদের প্রকৃত ঈমানের পরিচয়
তাঁর জীবনী জানলেই আমরা বুঝব ইসলাম কেবল ধর্ম নয়, একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা

আল্লাহ বলেন:
তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।
সূরা আহযাব: ২১

সারসংক্ষেপ:
ঈদে মিলাদুন্নবী হলো নবীজির জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশের একটি উপলক্ষ। কিন্তু তার চেয়ে বড় হলো তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া, অনুসরণ করা এবং প্রচার করা।

ঈদে মিলাদুন্নবী কিভাবে পালন করা হয়

ঈদে মিলাদুন্নবী মুসলিম সমাজে নানা রূপে পালন করা হয়, যা ভৌগোলিক অঞ্চল, সংস্কৃতি ও মাজহাব অনুযায়ী ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে মূল উদ্দেশ্য থাকে নবী মুহাম্মদ (সা.) এর জন্ম, জীবন ও আদর্শ স্মরণ এবং তা অনুসরণে উৎসাহিত হওয়া।

  1. কোরআন তিলাওয়াত ও দোয়া মাহফিল
    মসজিদ, মাদরাসা ও ঘরে কোরআন তিলাওয়াত
    বিশেষ দোয়া ও মোনাজাত
    দুরুদ শরীফ পাঠের আয়োজন
  2. নবীর সীরাত আলোচনা
    নবীর জন্ম, চরিত্র, দাওয়াহ, জিহাদ, পরিবারিক জীবন ও ইন্তেকাল সম্পর্কে আলোচনা
    মিলাদ মাহফিল বা ওয়াজে ইসলামিক বক্তারা নবীর জীবন তুলে ধরেন
  3. ইসলামী সংস্কৃতি প্রচার
    হামদ নাত, কাব্য আবৃত্তি
    কুইজ ও সীরাত প্রতিযোগিতা শিশু কিশোরদের মাঝে
    ইসলামী বই বিতরণ, সীরাত পোস্টার বা ব্যানার ব্যবহার
  4. দান খয়রাত ও সমাজসেবা
    গরিব দুঃখীর মাঝে খাবার বিতরণ
    এতিম, মাদরাসা ছাত্রদের সহায়তা
    রক্তদান, স্বাস্থ্যসেবা ক্যাম্প আয়োজন
  5. আলোকসজ্জা ও র‌্যালি
    রাস্তাঘাট, মসজিদ, ঘরবাড়ি সাজানো
    কিছু এলাকায় র‌্যালি, মিছিল বা শোভাযাত্রা হয় (যা শরিয়তসঙ্গতভাবে সীমিত রাখা উচিত)

ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করলে কোন কোন বিষয়গুলো এড়িয়ে চলা উচিত

  • গান বাজনা, নাচ, অশ্লীলতা
  • নারী পুরুষ মিশ্র পরিবেশ
  • শিরকী কার্যকলাপ (যেমন: মাজারে কু প্রথা)
  • অতিরিক্ত খরচ বা অপচয়

সারসংক্ষেপ:
ঈদে মিলাদুন্নবী কিভাবে পালন করা হবে, তা নির্ভর করে উদ্দেশ্য ও পদ্ধতির উপর। যদি এটি হয় শুধুমাত্র নবীজির জীবনী স্মরণ, শিক্ষা গ্রহণ ও সুন্নাহ প্রচারের মাধ্যমে, তাহলে এটি কল্যাণকর হতে পারে।

ঈদে মিলাদুন্নবী কখন

ঈদে মিলাদুন্নবী মুসলিম বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মতে ১২ই রবিউল আউয়াল তারিখে পালিত হয়, যেদিন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) দুনিয়ায় আগমন করেন।

নবীজির জন্মদিন: কোন দিন?

  • তারিখ: ১২ রবিউল আউয়াল (বেশিরভাগ মতামত)
  • বছর: হস্তী বৎসর / ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দ
  • বার: সোমবার
    (হাদীস দ্বারা প্রমাণিত: সহিহ মুসলিম, হাদীস: ১১৬২)

হাদীস:
“এই সোমবারে আমি জন্মগ্রহণ করেছি।”
সহিহ মুসলিম: ১১৬২

হিজরি ও গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে তারিখ পরিবর্তন
হিজরি বছর চন্দ্র বছরের উপর ভিত্তি করে হওয়ায় প্রতি বছর ঈদে মিলাদুন্নবীর তারিখ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে পরিবর্তিত হয়।

উদাহরণস্বরূপ:
২০২৫ সালে ঈদে মিলাদুন্নবী পড়বে ০৬ সেপ্টেম্বর

সারসংক্ষেপ:
ঈদে মিলাদুন্নবী প্রতি বছর ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে পালিত হয়, যেটা ইসলামী ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোর একটি। এই দিন মহানবী (সা.) এর জন্মের স্মৃতিকে কেন্দ্র করে মুসলিমরা শিক্ষা ও ইবাদতের মাধ্যমে তা উদযাপন করে।

ঈদে মিলাদুন্নবী ২০২৫

ঈদে মিলাদুন্নবী ২০২৫ সালের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক দিবস, যা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্মদিন হিসেবে উদযাপিত হয়।

২০২৫ সালে ঈদে মিলাদুন্নবী ০৬ সেপ্টেম্বর (শনিবার)
(চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল)

হিজরি তারিখ:
১২ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭ হিজরি

২০২৫ সালের মিলাদ উদযাপন: কী কী করতে পারেন?

  • কোরআন তিলাওয়াত ও দোয়া মাহফিল
  • নবীজির সীরাত আলোচনা সভা
  • দান খয়রাত
  • ইসলামিক বই বিতরণ
  • দুরুদ শরীফ পাঠ
  • ইসলামিক প্রতিযোগিতা ও সীরাত প্রদর্শনী

স্মরণ রাখা জরুরি:
মিলাদ উদযাপন যেন শরিয়তসঙ্গত হয়
বিদআত, অপচয়, গান বাজনা ও শিরকি কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকা
এ দিন যেন আত্মসংশোধন ও নবীর আদর্শ গ্রহণের দিন হয়

সারসংক্ষেপ:
ঈদে মিলাদুন্নবী ২০২৫ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর (সম্ভাব্য) তারিখে পালিত হবে। এটি এমন একটি দিন, যখন মুসলিমরা নবীজির প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করে।

ঈদে মিলাদুন্নবী সম্পর্কিত সাধারণ প্রশ্নোত্তর

  1. ঈদে মিলাদুন্নবী কী?
    ঈদে মিলাদুন্নবী হলো মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্মদিন, যা ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে পালিত হয়।
  2. ঈদে মিলাদুন্নবী কবে পালিত হয়?
    হিজরি বর্ষের ১২ রবিউল আউয়াল তারিখে। ২০২৫ সালে এটি পড়বে ১৩ সেপ্টেম্বর (সম্ভাব্য)।
  3. ঈদে মিলাদুন্নবীর ইসলামিক ভিত্তি আছে কি?
    সরাসরি কোনো সহিহ হাদিসে এ দিবস পালনের নির্দেশ নেই। কেউ কেউ পরোক্ষভাবে কুরআন হাদিস থেকে দলিল দেন, আবার কেউ একে বিদআত মনে করেন।
  4. মিলাদুন্নবী পালন করা কি জায়েজ?
    মতভেদ রয়েছে। কিছু আলেম জায়েজ বলেন যদি তা সীমার মধ্যে হয়; আবার অনেকে একে বিদআত বলে নিষিদ্ধ করেন।
  5. নবীজির জীবনী জানা কেন জরুরি?
    কারণ আল্লাহ নিজেই বলেন, “তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ” (সূরা আহযাব: ২১)। জীবনী না জানলে আদর্শ অনুসরণ সম্ভব নয়।
  6. ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে কী করা উচিত?
    দোয়া মাহফিল
    দরূদ পাঠ
    সীরাত আলোচনা
    দান সদকা
    বিদআত ও অপসংস্কৃতি পরিহার

উপসংহার

ঈদে মিলাদুন্নবী শুধু একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি আমাদের ঈমানের অনন্য স্মারক যা আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবন, আদর্শ ও শিক্ষার দিকে ফিরে তাকাতে শেখায়। তাঁর জন্ম কেবল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং এটি ছিল মানবজাতির মুক্তির সূচনা।

এই দিন আমাদের মনে করিয়ে দেয়:
আমরা কীভাবে তাঁর আদর্শ থেকে দূরে সরে গেছি
তাঁর সুন্নাহ অনুসরণ করা ছাড়া প্রকৃত ইসলামী জীবন সম্ভব নয়
ভালোবাসা কেবল মুখে নয়, জীবনে বাস্তবায়নের মাধ্যমেই প্রকৃত শ্রদ্ধা প্রকাশ পায়

শরিয়তসঙ্গত পদ্ধতিতে ঈদে মিলাদুন্নবী পালন করলে তা আমাদের অন্তরকে আলোকিত করতে পারে, সমাজে শান্তি ও কল্যাণ বয়ে আনতে পারে। তবে ভুল আকীদা, বিদআত বা বাড়াবাড়ি এড়িয়ে চলাই সর্বোত্তম।
আসুন, নবীজির জীবনী জানি, বুঝি এবং অনুসরণ করি।
এটাই ঈদে মিলাদুন্নবীর প্রকৃত শিক্ষা।


Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url